তানসেনের তানপুরা – রহস্যের তালা খুলছে সুরের চাবি

-

লকডাউনের অনেক ডাউন সাইডের মধ্যে দুটি বড় দিক-

ক) সোশ্যাল মিডিয়া আমার আপনার রাগপ্রকাশের সর্বোচ্চ প্রকাশ মাধ্যম।

খ)  এই প্রকাশ মাধ্যমে প্রশংসা প্রতিষিদ্ধ।নতুন কিছু দেখে, শুনে, পড়ে যদি গলা জড়িয়ে কোঁদুলে সুরে (বে অথবা অ)  নিন্দে মন্দ না করেন তাহলে তফাৎ যান। আপনি ভাই এলেবেলে।

এরকমই এক পরিস্থিতিতে কানে এল আরেক রাগের কথা। যেই রাগের সাথে আমার প্রথম পরিচয় সম্ভবত মায়ের গর্ভাবস্থার সময় থেকে। নানান বর্নময় রূপে,  রাগেদের সাথে দেখা হয়েছে আমার। কিন্তু ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের (পড়ুন ভারতীয় সঙ্গীত, এর যেকোনো রূপেই প্রায়, রাগ স্যার বা রাগিণী ম্যামের অবাধ যোগ) সূত্র ধরে রহস্য উন্মোচন – তাও আবার তানসেনের তানপুরার, এই চমক প্রথমবার। এর আগে বাইশে শ্রাবনও  এইভাবেই অবাক করেছিল, ভাবতেই পারিনি যে বাঙলা কবিতা দিয়ে একটা মার্ডার মিস্ট্রির সমাধান করা হচ্ছে। তানসেনের তানপুরার এই অভূতপূর্ব ভাবনাকে আমি সবার আগে স্যালুট জানাই।

এর আগের ব্লগে মাস এবং ক্লাস নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে তাই সে বিষয়ে বেশী বলতে চাইছিনা। শুধু একটা কথা বলা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ – যে দুর্ভাগ্যবশত আমরা আমাদের পরম সম্পদ – আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আমরা কেমন বাড়ির বড় কর্তা গিন্নীর মত সযত্নে, ভক্তিভরে একটা গণ্ডি কেটে, তার ভেতর রেখে দিয়েছি। আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের থেকে একটু যেন দূরে, একটু উপরে। তাকে আমাদের জীবনেরই একটা  অঙ্গ করা হয়ে ওঠেনি বিশেষ। ঠিক যেমন খাপ খায় না ভেবে বাড়ির সবরকম আড্ডায় সবসময় প্রৌঢ়দের অলিখিত প্রবেশ নিষেধ থাকে, অনেকটা সেরকম। সেইরকম আবহে বাঙলায় নায়ক নায়িকা প্রেমের  গান গাইছেন – ‘তবে সে আন্ধারে নিখাদে গান্ধারেকে তাকে প্রাণ ধারে, প্রেয়সী তোমা বিনা  – তাও আবার শুদ্ধ যোগ রাগের এক অনবদ্য অধরবন্ধ  বন্দিশে – এ যেন শুনতে গিয়েও বিশ্বাস হতে চায়না।

তানসেনের তানপুরা ‘হইচই’ এর একটি ওয়েব সিরিজ । সৌমিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত। এখানে শুধু গান নয়, ছবিও সাহায্য করছে জুড়ে দিতে ‘ জিগ শ পাজল’  গুলো। গল্প অসাধারণ। লোকেশন, অভিনয় প্রশংসাযোগ্য তো বটেই। তবে সিরিজটির  আসল হিরো এর সঙ্গীত বিভাগ।

শ্রীজাতর এই জাতকেরা একেবারেই নতুনরুপে শ্রীযুক্ত।ভবিষ্যতে এরকম আরো বাংলা খেয়াল,  বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা  ধামার, বাংলা  ঠুমরীর অনুরোধ, আবদার এবং একনিষ্ঠ পাঠিকা হিসাবে বায়নাও  জুড়ে দিলাম।

এই সিরিজের প্রতিটা মুহূর্তের  পিছনে সুরকার হিসাবে  শ্রী জয় সরকারের ভাবনা – অভাবনীয়। খেয়াল, টপ্পা, কাওয়ালী এই সমস্ত টেবিলের ওপারে রাখা অসামান্য  ধারাগুলোকে – বাঙলায় এবং সর্বোপরি –“মেইন স্ট্রীম” মিউজিকে বড্ড সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন উনি।

জীমূত রায় সবচেয়ে বেশী অবাক করেছেন।  অবিশ্বাস্য রকমের ভালো গেয়েছেন প্রত্যেকটি গান। পিয়ু মুখার্জীর গান সবসময়ই অপূর্ব, তবে এক্ষেত্রে গল্পের খাতিরে হয়েত একটু লো প্রোফাইলে গাইতে হয়েছে  কিন্তু তবু বড় সুন্দর। তবে পণ্ডিত নীহার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া নিধুবাবুর টপ্পা, ওনার খানদানী গায়কী, সূক্ষ্ম জমজমার কাজ  মনে করিয়ে দেয় যে কত বছরের নিরন্তর সাধনায় সুর অমন অনায়াসে ধরা দেয় –“অনুগত জনে ….তুমি মারিলে মারিতে পারো” ।

আলাদা করে বাঁশির কথা বলাটা দরকার। আবারো গল্পের খাতিরে হংসধ্বনী পর্বে বাঁশিকে হার মানতে হয় আলাপ, মানে প্রধান নায়কের কণ্ঠসঙ্গীতের কাছে। ঠিক যেভাবে প্রায় আটষট্টি বছর আগে গল্পের তাগিদে বৈজু বাওরা ছবিতে পণ্ডিত ডি ভি  পালুস্কারের মত শিল্পিকেও হেরে যেতে হয়েছিল উস্তাদ আমীর খান সাহেবের কাছে। এখানেও বাঁশি কোন অংশে কণ্ঠসঙ্গীতের চেয়ে এতটুকু কম ছিলনা, আসলে আমার ঠিক উল্টোটাই মনে হচ্ছিল।

খ্রীস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের পরেও নাকি  তাকে – ‘এ আর এমন কি ব্যাপার, এ তো যে কেউ করতে পারতো, আরো আগেই করতে পারতো’ ,  – ইত্যাদি প্রভৃতি  দুয়ো  দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প আছে। কলম্বাস নাকি তাদের  হাতে একটি আস্ত ডিম ধরিয়ে বলেন টেবিলের মাঝখানটায় ওটিকে বসিয়ে দিতে । বিস্তর মাথা কান চুলকে সবাই ফেল করায় উনি ডিমটাকে ভেঙ্গে খোলার অর্ধেকটা টেবিলের মাঝে বসিয়ে উঠে যান।

এ গল্পের সত্যাসত্য জানিনা, তবে এখানে কেন এই গল্প বললাম তা নিশ্চয়ই পাঠকেরা বুঝেছেন। এই সিরিজ দেখে এবার প্রথা মেনে হয়েত নিন্দে মন্দ শুরু হবে। আমরা আমাদের ডিগ্রীর গম্ভীর চশমা এঁটে বলে উঠবো – আরে ইয়ে তো বাচ্চোওয়ালী কাম হ্যায়। এ সব তো সবাই জানে।  সা রে গা মা পা র সেদিনের ছেলে ছোকরাদের দিয়ে এইসমস্ত দুরূহ জিনিশ গাওয়ানোর কারণ কি, কারণটা  হল সহজ করে প্রকাণ্ড কিছুর গল্প বলা আমাদের ঠিক ধাতে সয় না। এমন করে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পেশ করতে হবে যা সকলের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। অমন সহজ করে ভরত মুনির করে যাওয়া বাদ্যাযন্ত্রের শ্রেণীবিন্যাস সবার সামনে না ধরলেই নয়। ডিগ্রীর চশমা বলবে আগলাও, কুক্ষিগত করো, তবে ভুলেও ওতে হাত দিয়ো না।

তানসেনের তানপুরার পুরো টিমকে আমি কুর্নিশ জানাই এরকম একটা সুন্দর উপস্থাপনার জন্য। এছাড়াও আরেকটা কারণ  আছে। তানসেনের তানপুরা ফিরিয়ে দিল আমার বছর ছয়েক আগের  কিছু মধুস্মৃতি। কলামন্দিরের বিশাল হলে আমার মেয়েরা বৃন্দগায়ন করছে, কেদারের এক মোহময় বন্দিশের অন্তরা – ‘কণ্ঠ বনে মোতিয়ন কি মালা’ । অথবা গীটারে বাজছে পাগল করা ব্লুজ, আর ঠিক কাঙ্ক্ষিত দুই গান্ধারের ছোঁয়ার  মুহুর্তে, গলায় মিশছে, রাগ যোগ  – “সাজন মোরে ঘর আয়ে” । এ যোগসূত্রই বলে দেয় – “আছে আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে” ।

Share this article

Recent posts

Popular categories

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments